সোনারগাঁও রচনা


সোনারগাঁও

ভূমিকাঃ সোনারগাঁও স্বর্ণগ্রাম বা সুবর্ণগ্রাম নামে অভিহিত বঙ্গের এক প্রাচীন জনপদ। ব্রহ্মপুত্রের উভয় তীর ব্যাপী বিস্তৃত এই জনপদেস্বর্ণভূষিতজাতি নামে চিহ্নিত এক আদিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। এরা ঐতিহ্যগতভাবেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত ছিল। প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম জনপদ পূর্বে মেঘনা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী এবং পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদী দ্বারা বেষ্টিত ছিল এবং এর উত্তর সীমা বিস্তৃত ছিল আধুনিক বৃহত্তর ঢাকা জেলার উত্তর প্রান্তসীমায় ব্রহ্মপুত্র নদী পর্যন্ত। আধুনিক ভৌগোলিক বিভাগের নিরীখে এই জনপদের অবস্থান নির্ধারণ করতে গেলে বলা যায় যে, প্রাচীনকালে এই জনপদের অবস্থান ছিল শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মধ্যবর্তী ওই ভূখন্ডে যা বর্তমানে নরসিংদী জেলা এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার বৃহত্তর অংশে বিস্তৃত।

প্রতিষ্ঠাকালঃ ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ কর্তৃক ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বাংলার প্রথম স্বাধীন মুসলিম সালতানাতের রাজধানী ছিল সোনারগাঁও, আর তখন থেকেই শুরু হয় সোনারগাঁয়ের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের। সোনারগাঁও সমগ্র পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণপূর্ব বঙ্গের সুলতানি শাসনের রাজধানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। সুলতান  শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ ও সিকান্দর শাহের শাসনামলে সোনারগাঁও ছিল পূর্ববঙ্গ প্রদেশের রাজধানী। পূর্ববঙ্গে গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের স্বাধীন শাসনামলে তাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁও।  ঈসা খান মসনদ-ই-আলা প্রতিষ্ঠিত ভাটি রাজ্যের রাজধানী ছিল সোনারগাঁয়ে।

বাণিজ্যকেন্দ্রঃ চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয় পাদে সোনারগাঁও একটি বাণিজ্যশহররূপে গড়ে ওঠে। সমুদ্রপথে পশ্চিম এশীয় ও দক্ষিণপূর্ব এশীয় দেশ থেকে বাণিজ্য-তরী সহজেই সোনারগাঁয়ে পৌঁছতে পারত।  ইবনে বতুতা ১৩৪৬ সালে সোনারগাঁওকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-নগরী রূপে বর্ণনা করেন এবং চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে এর সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেন। চীনের পরিব্রাজক  মা হুয়ান ১৪০৬ সালে সোনারগাঁওকে একটি বিরাট বাণিজ্যিক শহররূপে প্রত্যক্ষ করেন। হৌ-হিয়েন ১৪১৫ সালে সোনারগাঁওকে বহু পুকুর, পাকা সড়ক ও বাজার সমৃদ্ধ একটি সুরক্ষিত প্রাচীর বেষ্টিত নগর এবং বাণিজ্যকেন্দ্ররূপে উল্লেখ করেন, যেখানে সব ধরনের পণ্যসামগ্রী মজুত ও বিক্রয় করা হতো।

সুফি-সাধকদের মিলনঃ শেখ আলাউদ্দিন আলাউল হক তাঁর পৌত্র শেখ বদর-ই-ইসলাম ও প্রপৌত্র শেখ জাহিদ সোনারগাঁয়ে ধর্মতত্ত্ব ও সুফিতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। আবু তাওয়ামা প্রতিষ্ঠিত খানকা ও মাদ্রাসা সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর আধ্যাত্মিক অনুসারীদের দ্বারা এবং পরবর্তীকালে প্রখ্যাত সুফিসাধক  সাইয়্যিদ ইবরাহিম দানিশমন্দ ও তাঁর বংশধর সৈয়দ আরিফ বিল্লাহ মুহাম্মদ কামেল,  সাইয়্যিদ মুহম্মদ ইউসুফ ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। সোনারগাঁও এক সময়ে ছিল বিখ্যাত সুফি দরবেশ ও ফকিরদের মিলনক্ষেত্র।



উপসংহারঃ ইতিহাসখ্যাত সোনারগাঁও নগর এখন শুধু নামেই রয়েছে। ঢাকা নগরীর প্রতিষ্ঠার পর থেকে সোনারগাঁও তার প্রাধান্য হারাতে থাকে এবং ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মধ্যে সোনারগাঁও পরিণত হয় ‘গভীর জঙ্গলে আচ্ছাদিত গন্ড গ্রামে’। কিন্তু প্রায় এক শতক কালের ব্যবধানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যোগাযোগ সুবিধার ফলে শীতলক্ষ্যা ও মেঘনার মধ্যবর্তী ভূভাগ এখন পরিণত হয়েছে একটি উৎপাদনশীল এলাকায়। মহাসড়কের উভয় পাশে পল্লবিত হয়েছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, গড়ে উঠেছে বহুতর শিল্প কারখানা। মহাসড়কের উত্তর পাশে পানাম ও গোয়ালদির দিকে এবং দক্ষিণ পাশে মোগরাপাড়ায় সম্প্রতি গড়ে ওঠা আধুনিক বসতি দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং এতে করে দিনে দিনে এলাকাটি রূপ নিচ্ছে একটি উপশহরের। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পাহাড়পুর রচনা

প্রতীক, সংকেত, যোজনী