শা'বান মাসে করনীয় বর্জনীয়

শা'বান মাসে করনীয় বর্জনীয়ঃ
শবে বারা‘আতের কারনে শা‘বানের মাসের গুরত্ব আমাদের নিকট অনেক বেশী। অনেকে এই ব্যাপারে একবারেই উদাসীন আর কিছু লোক এই আমলকে সামনে রেখে অনেক শরী‘আত বিরোধী কাজ করে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে এর যথার্থ বিশ্লেষণ নিন্মে দেয়া হলোঃ
শরীআতের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত
লাইলাতুল বারা‘আতের ফযীলত নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিত কোন রূপ না দিয়ে এবং এ রাত উদযাপনের বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন না করে শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী বেশী বেশী ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। এখানে লাইলাতুল বারা‘আতের ফযীলত ও করণীয় বিষয়ের কিছু হাদীস যথাযথ উদ্ধৃতি ও সনদের নির্ভরযোগ্যতা সহ উল্লেখ করা হলো।
প্রথম হাদীস
হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল রাযি. বলেন. নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন আল্লাহ তা‘আলা ১৫ই শা‘বানের রাতে সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান-৫৬৬৫, সিলসিলাতুল আহাদীছিস সহীহাহ-৩/৩১৫)
দ্বিতীয় হাদীস
হযরত আ‘লা ইবনুল হারেস থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন, আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলী নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলী নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন, তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা/হুমাইরা! তোমার কি এ আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না; ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা? নবীজী জিজ্ঞাসা করলেন. তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূল তখন ইরশাদ করলেন, এটা অর্ধ শা‘বানের রাত। আল্লাহ তা‘আলা এ রাতে বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন ও অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষপোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (শু‘আবুল ঈমান-হাদীস নং- ৩৬৩৫)
তৃতীয় হাদীস
একদা হযরত আয়েশা রাযি. হুযুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে না পেয়ে খুঁজতে বের হলেন। তাকে জান্নাতুল বাকীতে পেলেন- তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ১৪ই শা‘বান দিবাগত রাতে আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং ‘বনূ কালব’ গোত্রের পালিত ছাগল পালের শরীরের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক বান্দাকে তিনি ক্ষমা করে দেন। (তিরমিযী শরীফ-হাঃ নং ৭৩৯, ইবনে মাযাহ- হাঃ নং ১৩৮৫)
চতুর্থ হাদীস
হযরত আলী ইবনে আবী তালেব রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন অর্ধ শা‘বানের রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাত্রি ইবাদত বন্দেগীতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোযা রাখ। কেননা এ রাতের সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমা প্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিযিক প্রার্থী? আমি তাকে রিযিক দিব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাকে ডাকতে থাকেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৩৮৪, শু’আবুল ঈমান-৩৮২৩-২২)
মাত্র কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করা হলো। আরো বহু হাদীস কিতাবে বর্ণিত আছে।
উল্লেখিত হাদীস সমূহের সনদ বিষয়ক আলোচনাঃ
১ম হাদীসের সনদ সহীহ, এ জন্য ইমাম ইবনে হিব্বান একে কিতাবুস সহীহ-এ বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুনযিরী, ইবনে রজব, কাস্তাল্লানী, যুরকাবী, নুরুদ্দীন হাইসামী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এ হাদীসটিকে আমলযোগ্য সহীহ বলেছেন। (দেখুন! তারগীব তারহীব ২/১১৮, ৩/৪৫৯ লাত্বাইফুল মা‘আরিফ ১৫১-৩, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫, শারহুল সাওয়াহিব-১০/৫৬১)
বর্তমানে আহলে হাদীস ভাইদের প্রসিদ্ধ শাইখ নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ. সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ ৩/১৩৫-১৩৯-এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেন, ‘এ সব রেওয়ায়েতের মাধ্যমে এ হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।’ এরপর শাইখ আলবানী রহ. ঐ সব লোকের বক্তব্য খণ্ডন করেন, যারা কোনধরনের খোঁজ-খবর ছাড়াই বলে দেন যে লাইলাতুল বরা‘আতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই। তদ্রূপ শাইখ আব্দুর রহমান মুবারকপূরী তুহফাতুল আহওয়াজী -২/৫৩-এ লাইলাতুল বারা‘আতের হাদীসকে আমলযোগ্য প্রমাণিত করেন।
২য় হাদীসটি ইমাম বাইহাকী রহ. বর্ণনা করার পর সনদের ব্যাপারে বলেছেন, ‘মুরসালুন জায়্যিদুন’ অর্থাৎ, আমলযোগ্য। ৩য় হাদীসটি আমলের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। সকল রাবী সিক্কাত, সনদের মধ্যে ইনক্বিতা থাকায় ইমাম বুখারী রহ. যয়ীফ বলেছেন। (দেখুন! সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ-৩/৩১৮)
৪র্থ হাদীসটির সনদ যয়ীফ কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কিরামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো- ফাযায়েলের ক্ষেত্রে যয়ীফ হাদীস গ্রহণযোগ্য। দেখুন! (কিতাবুল আযকার-৭, ফাতহুল কাদীর-১/৪৬৭, আল আজবিবাতুল ফাযেলাহ-৫৭)
ফুক্বাহায়ে কেরামের দৃষ্টিতে লাইলাতুল বারাআত
ফিক্বহে হানাফী
আল্লামা শামী, ইবনে নুজাইম, আল্লামা শরমবুলালী, শাইখ আব্দুল হক দেহলভী, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী, মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষনৌভী, মুফতী মুহাম্মদ শফী সাহেব রহ. সহ প্রমুখ উলামায়ে কেরামের মতে লাইলাতুল বারা‘আতে শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী জাগ্রত থেকে একাকীভাবে ইবাদত করা মুস্তাহাব, তবে জমায়েত হয়ে নয়। (আদ দুররুল মুখতার-২/২৪-২৫, আল বাহরুর রায়িক-২/৫২, মা ছাবাতা বিসসুন্নাহ-৩৬, মারাক্কিল ফালাহ-২১৯, জাওয়ালুস সিনাহ-১৭, লাইলাতুল বরা‘আতের হাক্বীক্বত- শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ তাক্বী উসমানী)
ফিক্বহে শাফেয়ী
ইমাম শাফী রহ.-এর মতেও শা‘বানের ১৫তম রাতে অধিক অধিক দু‘আ কবূল হয়ে থাকে।  (কিতাবুল উম্ম-১/২৩১)
ফিক্বহে হাম্বলী
শাইখ ইবনে মুফলিহ হাম্বলী, আল্লামা মানসূর আল বাহুতী এবং ইবনে রজব হাম্বলী রহ. সহ প্রমূখ উলামায়ে কিরামের নিকট লাইলাতুল বারা‘আতে ইবাদাত করা মুস্তাহাব। (দেখুন! আল মাবদা-২/২৭, কাশশাফুল কিনা-১/৪৪৫, লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ-১৫১-৬০)
ফিক্বহে মালিকী
ইবনুল হাজ্জ্ব মালিকী রহ. বলেন সলফে সালিহীন তথা পূর্বযুগের আউলিয়াগণ এ রাতকে যথেষ্ট সম্মান করতেন এবং এর জন্য পূর্ব থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। (আল মাদখাল-১/২৯২-৯৩)
সারকথাঃ সকল মাযহাবের উলামায়ে কিরামের মতে লাইলাতুল বারা‘আতে ইবাদাত করা মুস্তাহাব।
আহলুল হাদীস ভাইদের প্রতি আবেদন
লাইলাতুল বারা‘আত সম্পর্কে কোন আপত্তি থাকলে আপনারা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ.-এর ইক্বতিযাউস সিরাতুল মুস্তাক্বীম-২/৬৩১-৬৪৩, আলবানী রহ. এর সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ-৩/১৩৫-১৩৯, ইমাম মুবারকপুরীর তুহফাতুল আহওয়াজী-২/৫৩ এবং ইবনে রজব হাম্বলীর লাত্বায়িফুল মা‘আরিফ ১৫১-১৬০ ইত্যাদি প্রমুখ উলামাদের কিতাব দেখুন।
করণীয় ও বর্জনীয়
এ রাতে করণীয়ঃ বেশী বেশী নফল ইবাদত, যেমন- কুরআন তিলাওয়াত, যে কোন সূরা দিয়ে নফল নামায, যিকির আযকার, দু‘আ ইস্তিগফার। উক্ত ইবাদাতসমূহ সমবেত ভাবে নয় বরং একাকী করতে হবে। উল্লেখ্য উক্ত রাতে কোন ধরা বান্ধা নিয়মে নফল নামায পড়া হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়। উল্লেখ্য লাইলাতুল বারা‘আতের পরদিন রোযা রাখা নফল ইবাদত, কেউ শা‘বানের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোযা রাখতে পারলে উত্তম।
বর্জনীয়ঃ আতশবাজী, হালুয়া রুটি, শিরণী-তাবাররুক, মাইকে কুরআন তিলাওয়াত ও শবীনা, আলোকসজ্জা করা, মসজিদে বা বাড়ীতে জমায়েত হয়ে বড় আওয়াজে প্রচলিত মীলাদ-কিয়াম করা, গোরস্থানে যাওয়া, মেলা বসানো, জামা‘আতের সাথে সালাতুত তাসবীহ বা তাহাজ্জুদের নামায পড়া ইত্যাদি। (বিস্তারিত দেখুন!লাইলাতুল বরা‘আতের হাক্বীক্বত মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উসমানী।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পাহাড়পুর রচনা

সোনারগাঁও রচনা

প্রতীক, সংকেত, যোজনী