জামিয়া রাহমানিয়া বিভক্তি
জামিয়া রাহমানিয়া বিভক্তি : একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ
তখন আশির দশক চলছে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমল। সে সময় বাংলাদেশে ইলম ও উলামায়ে কেরামের মজবুত কেল্লা ছিল—জামিয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ। এখানে উস্তাদ ছিলেন মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ রহ., শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক রহ., মুফতি ফজলুল হক আমিনি রহ., মুফতি মনসুরুল হক দা.বা., মাওলানা হিফজুর রহমান দা.বা., মাওলানা আবদুল গাফফার রহ., মাওলানা আলি আসগর রহ. ও মাওলানা মুজিবুর রহমান সাহেবদের মতো আমাদের সেরেতাজ উলামায়ে কেরাম। আর তাঁদের সকলের মুরুব্বি ছিলেন লালবাগ জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা—হজরত মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর রহ.।
সমস্যাটা শুরু হয় ১৯৮১ সালে, হাফেজ্জি হুজুরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর থেকে। লালবাগ মাদরাসার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মাদরাসায় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু হাফেজ্জি হুজুরের খেলাফত আন্দোলনের ঘাঁটি হয়ে যায় লালবাগ মাদরাসা। এবং স্বাভাবিকভাবেই লালবাগের ছাত্ররা খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এতে পড়াশোনার ক্ষতি হয় বলে মাদরাসা কমিটি আপত্তি করতে থাকে। পরে ১৯৮৬ সালে আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান হাফেজ্জি হুজুর। প্রথম নির্বাচনে তিনি তৃতীয় স্থান লাভ করলেও এবারের নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।
হাফেজ্জি হুজুরের ক্ষেলাফত আন্দোলন করতেন শাইখুল হাদিস আজিজুল হক সাহেব এবং মুফতি ফজলুল হক আমিনি সাহেব। শাইখুল হাদিস সাহেব তখন লালবাগ মাদরাসার বুখারির শাইখ ছিলেন। আর আমিনি সাহেব ছিলেন মুহাদ্দিস এবং কার্যকরী মুহতামিম। আর মুফতি মনসুরুল হক সাহেব ও মাওলানা হিফজুর রাহমান সাহেদ্বয়ও ছিলেন মুহাদ্দিস এবং মাদরাসার প্রশানিক বিভিন্ন সেক্টরে দায়িত্বশীল। সে সময় হাফেজ্জি হুজুর তখন অশীতিপর বৃদ্ধ ছিলেন এবং খেলাফত আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাই হাফেজ্জি হুজুরের জামাতা হিসেবে আমিনি সাহেবই মাদরাসার ইহতিমামির দায়িত্ব আদায় করতেন।
মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতির পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিলেন মুফতি আমিনি রহ.। মাদরাসার ভেতরে ও বাইরে তাঁর একটি শক্তিশালী বলয় ছিল। এদিকে মাদরাসার সব উস্তাদরা আবার খেলাফত আন্দোলন করতেন না এবং ছাত্র রাজনীতিকেও সাপোর্ট করতেন না। কমিটি ও অনেক উস্তাদদের আপত্তি সত্বেও মাদরাসায় ছাত্র রাজনীতি চলতে থাকে। রাজনীতিকে কেন্দ্র করে মাদরাসার পরিস্থিত দিনদিন ঘোলাটে হতে থাকে এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। এরই জের ধরে যখন একদিন মাদরাসার খুবই হিতাকাঙ্ক্ষী, মুখলিস ও দীনদার মুতাওয়াল্লিকে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছাত্ররা পেটাল, তখন এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে আর সহ্য করতে পারলেন না সকলেরই মুরুব্বি উস্তাদ—মাওলানা হেদায়াতুলাহ সাহেব; তিনি মাদরাসা ছড়ে চলে গেলেন।
মাদরাসার অর্থনৈতিক লেনদেনের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে মুফতি আমিনি রহ.-কে মাদরাসা থেকে অব্যাহতি প্রদান করে কমিটি। এরকমভাবে শাইখুল হাদিস আজিজুল হক সাহেবকেও রাজনীতি করার কারণে অব্যাহতি প্রদান করে কমিটি। পরে ছাত্র অভ্যুত্থান এর মাধ্যমে শাইখুল হাদিস সাহেব আবারও মাদরাসায় পুনর্বহাল হন। এরকম নাজুক ও জটিল সময়েও মাদরাসায় ছিলেন মুফতি মনসুরুল হক সাহবে ও মাওলানা হিফজুর রহমান সাহেবগণ এবং মাদরাসার প্রশাসনিক দিক সামলিয়ে চলেন। এসবকিছুই চলে বয়োবৃদ্ধ হাফেজ্জি হুজুরের চোখের সামনে; কিন্তু তাঁর করার কিছুই ছিল না—যেহেতু মাদরাসা কমিটি পরিচালিত এবং সংবিধানের আওতাভুক্ত।
তখনও মুফতি আমিনি রহ. মাদরাসার বাইরে। ইসলাহ হয়ে গেছে—এই যুক্তিতে হাফেজ্জি হুজুর রহ. চাইলেন জামাতাকে মাদরাসায় ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু শাইখুল হাদিস সাহেবসহ প্রায়সকল উস্তাদ এ-মতের বিরোধিতা করেন। এখান থেকেই শাইখুল হাদিস সাহেবের সাথে আমিনি সাহেবের মোটাদাগে একটা ‘বিরোধ’ সৃষ্টি হয়। পরে ১৯৮৬ সালে আমিনি সাহেব নিজের গড়া সেই বলয়ের মাধ্যমে মাদরাসায় প্রবেশ করেন এবং মাদরাসার দায়িত্ব হাতে তুলে নেন। এহেন পরিস্থিতিতে শাইখুল হাদিস সাহেব লালবাগ ছেড়ে চলে আসেন। তাঁর সাথে চলে আসেন তাঁর ছাত্র—মুফতি মনসুরুল হক সাহেব ও মাওলানা হিফজুর রাহমান সাহেবগণ।
তছনছ হয়ে যায় লালবাগ মাদরাসা। লালবাগের রথীমহারথী প্রায়সকল উস্তাদ লালবাগ ছেড়ে চলে আসেন। এর একবছর পর ১৯৮৭ সালে হাফেজ্জি হুজুর দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নেন। লালবাগ জামিয়াকে মুফতি আমিনি রহ. নিজের মতো করে ঢেলে সাজান। কালের পরিক্রমায় খেলাফত আন্দোলন থেকে ইসলামি ঐক্যজোটের ঘাঁটিতে পরিণত হয় লালবাগ জামিয়া। তবে লালবাগ জামিয়া তার আগের সেই জৌলুস ফিরে পায়নি; আজও না। এটা অনেকেই স্বীকার করতে চাইবেন না; তবুও এটাই বাস্তবতা।
হাফেজ্জি হুজুরের সাথে মুহাম্মদপুরের হাজি সিরাজুদদৌলা সাহেবের ছিল কুটুম্বিতা। তাঁর মুহাম্মদি হাউজিংয়ে আগে থেকেই ঘরোয়া পরিবেশে একটি ‘মকতব মাদরাসা’ চালু ছিল—যার দায়িত্বে ছিলেন মাওলানা আবদুল আউয়াল সাহেব। আবদুল আউয়াল সাহেব দেখলেন—লালবাগের একঝাঁক নামকরা উস্তাদ বেরিয়ে এসেছেন। তিনি সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইলেন। হাজি সিরাজুদ্দৌলা সাহেবের অনুমতিপূর্বক তিনি লালবাগ ছেড়ে আসা উস্তাদদের মধ্যে কর্মঠ ও প্রশাসনিক পরিচালনায় দক্ষ নওজোয়ান আলেম—মুফতি মনসুরুল হক সাহেবকে এখানে নিয়ে আসেন।
মুহাম্মদি হাউজিংয়ে মাওলানা আবদুল আউয়াল সাহেবের সহায়তায় মুফতি মনসুরুল হক সাহেব প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুহাম্মাদিয়া মাদরাসা’। এখানে আসার জন্য তিনি একে একে যোগাযোগ করেন লালবাগের সাবেক সব উস্তাদের সাথে। ছাত্রের আহবানে ‘লাব্বাইক’ জানিয়ে চলে আসেন শাইখুল হাদিস সাহেব, মাওলানা হিফজুর রাহমান সাহেব, মাওলানা আবদুল গাফফার সাহেব, মাওলানা আলি আসগর সাহেবসহ অনেকেই। লালবাগের সাবেক রথীমহারথী উস্তাদদের মিলনাস্থলে পরিণত হয় মুহাম্মদপুরের ‘জামিয়া মুহাম্মাদিয়া’ মাদরাসাটি। পুরোদস্তুর পড়াশোনা চলতে থাকে। ‘আলিফ বা তা সা’ থেকে নিয়ে ‘ক্বালা ক্বালা হাদ্দাসানা’র সুর লহরীতে মুখরিত হয়ে উঠে মুহাম্মাদিয়া মাদরাসা।
প্রথমে মুহাম্মাদি হাউজিং এর মালিক মাদরাসার জন্য জমির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু বছরখানেক চলে যাবার পরেও তিনি পারিবারিকভাবে চলা এই বিশাল মাদরাসার জন্য জমি দিতে পারেননি। এতে ছাত্র-উস্তাদদের এখানকার সংকীর্ণ পরিবেশে কষ্ট হবার কারনে উস্তাগণ জমির ব্যাপারে তাঁর সাথে চূড়ান্ত আলাপ করেন। কিন্তু তিনি জমি দিতে অপারগ বলে জানান এবং মাদরাসার অন্যত্র ব্যবস্থা করতে বলেন। এতে মুহাম্মাদি মাদরাসার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তখন শাইখুল হাদিস রহ. তাঁর বাসায় চলে যান, আর হিফজুর রাহমান সাহেব চলে যান তাঁর নিজ এলাকা—চাঁদপুরে। অন্যান্য উস্তাদগণও মাদরাসা ছেড়ে চলে যান। কিন্তু ঢাকায় থেকে যান মুফতি মনসুরুল হক সাহেব।
ত্রিশের কোঠার একজন টগবগে যুবক, ধীমান, পরিশ্রমী ও অত্যন্ত যোগ্য আলেম মুফতি মনসুরুল হক সাহেব তখন চিন্তা করতে থাকেন—কীভাবে তছনছ হয়ে যাওয়া এই বাগানকে আবারও আবাদ করা যায়! অনেক চিন্তার পর কোনো উপায় না পেয়ে তিনি ছাত্র ও উস্তাদদের নিয়ে ঢাকার ঐতিহাসিক সাত গম্বুজ মসজিদে গিয়ে উঠেন। ছোট্ট ও পুরোনো জীর্ণশীর্ণ এই মসজিদে পড়াশোনা চালু করেন। এবারেও তিনি ডেকে নিয়ে আসেন আগের উস্তাদদেরকে। বিশেষ করে তাঁর সহকর্মী—মাওলানা হিফজুর রাহমান সাহব দা.বা.-কে। তদ্রুপ তাঁর উস্তাদ—শাইখুল হাদিস সাহেব রহ.-কেও এখানে তাশরিফ নিয়ে আসার অনুরোধ করেন। তিনি প্রথমে আসতে রাজি না হলেও পরে যখন ‘পাঠদান’ ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হবে না—বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, তখন তিনি আসেন এবং মাদরাসায় পড়ানো শুরু করেন।
এই সাত মসজিদেই ভাসমান অবস্থায় চলতে থাকে উস্তাদ ও সহকর্মীদেরকে নিয়ে মুফতি মনসুরুল হক সাহেবের ‘ভাঙা মুহাম্মাদিয়া মাদরাসা’র কার্যক্রম। তখনও মাদরাসাটির ‘মুহতামিম’ ছিলেন মুফতি মনসুরুল হক সাহেব। আর হবেনই বা না কেন; তিনিই তো শুরু থেকে মুহাম্মাদিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা! এই কথাটা দ্ব্যর্থহীন সত্য। যাক, তখন বুখারির ‘শাইখ’ ছিলেন শাইখুল সাহেব এবং ‘নাজিমে তালিমাত’ ছিলেন মাওলানা হিফজুর রাহমান সাহেব। কিন্তু সাত মসজিদের ভাসমান মাদরাসায় অনেক প্রবীণ উস্তাদদের মধ্যে মাদরাসার মুহতামিম—মুফতি মনসুরুল হক সাহেবের বয়েস কম হওয়ায় তাঁর পরিবর্তে মুহতামিম সাব্যস্ত করা হয় মাওলানা আবদুল গাফফার রহ.-কে। তখন থেকেই মুফতি মনসুরুল হক সাহেব ‘নায়েবে মুহতামিম’ হন। তবে তিনি নায়েবে মুহতামিম হলেও আসলে ছিলেন ‘নির্বাহী মুহতামি’ বা ‘কার্যকরী মুহতামিম’।
১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮—এই দুবছর অত্যন্ত মানবেতরভাবে দিনাতিপাত করেন সাত মসজিদের ভাসমান মাদরাসার উস্তাদ ও ছাত্ররা। মসজিদ থেকে কোনো ভবনে গিয়ে উঠার খুবই দরকার ছিল তাঁদের। পড়াশোনার পাশাপাশি আল্লাহর কাছে রোনাজারি তো ছিলই; চেষ্টা-তদবিরও সমানতালে চলছিল। অতঃপর ১৯৮৮ সালে আল্লাহর মেহেরবানিতে এবং শাইখ নুরুদ্দিন গহরপুরি রহ.-এর অনুরোধে আলি এন্ড নুর রিয়েল এস্টেটের মালিক হাজি মুহাম্মাদ আলি ও হাজি নুর হুসাইন—এই দুভাই মাদরাসার জন্য প্রথমে দশ কাঠা এবং পরে ১৯৯২ সালে আরও ছয় কাঠা জমি দান করেন। মোট ষোল কাঠা জমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় পাঁচতলা ভবনের দৃষ্টিনন্দন মাদরাসা এবং এটির নতুন নামকরণ করা হয়—জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মুহাম্মাদপুর, ঢাকা।
১৯৮৮ সালে সাত মসজিদের ভাসমান মুহাম্মাদিয়া মাদরাসা থেকে স্থানান্তরিত হয়ে জামিয়া রাহমানিয়া প্রতিষ্ঠার সময়েও মুহতামিম ছিলেন—মাওলানা আবদুল গাফফার রহ.। তখন ‘নায়েবে মুহতামিম’ হিসেব কার্যকরী মুহতামিম ছিলেন মফতি মনসুরুল হক সাহেব। ১৯৯০ সালে অসুস্থতার কারণে কমিটি আবদুল গফফার সাহেবকে অব্যাহতি দিয়ে মুহতামিম নিযুক্ত করে মাওলানা আলি আসগর সাহেবকে। তখনও নায়েবে মুহতামিম হিসেবে কার্যকরী মুহতামিম ছিলেম মফতি মনসুরুল হক সাহেব। জামিয়া রাহমানিয়ার ইহতিমামির পালাবদলকালেও ‘শাইখ’ হিসেবে জামিয়ার সর্বোচ্চ সম্মানিত আসনে সমাসীন ছিলেন শাইখুল হাদিস রহ.। পরে ১৯৯২ সালে মাওলানা আলি আসগর সাহেব নিজ দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করলে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুহতামিম বানিয়ে সম্মানিত করা হয় শাইখুল হাদিস রহ.-কে। তখনও নায়েবে মুহতামিম ছিলেন মুফতি মনসুরুল হক সাহেব।
১৯৯২-১৯৯৮ সাল—এই সাতটা বছর ছিল অবিভক্ত রাহমানিয়া মাদরাসার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই পুরোটা সময়ে মুহতামিম ছিলেন শাইখুল হাদিস সাহেব এবং নায়েবে মুহতামিম ছিলেন মুফতি মনসুরুল হক সাহেব। এই সময়েই শাইখুল হাদিস সাহেবের সাথে মুফতি মনসুরুল হক সাহেবের একটা ‘নীরব বিরোধ’ সৃষ্টি হয়। আর এর কারণ সেই পুরোনো কাসুন্দি—মাদরাসায় রাজনীতি চর্চা। রাহমানিয়া মাদরাসার সংবিধানেও মাদরাসায় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। শাইখুল হাদিস সাহেব ছিলেন একজন ‘রাজনীতিধর্মী’ মানুষ, আর মুফতি সাহেব ছিলেন ‘রাজনীতিবিমুখ’ মানুষ। শাইখুল হাদিস সাহেব নিজেও মাদরাসায় রাজনীতি চলুক—এটা বলতেন না; তবুও মাদরাসায় কিছুটা রাজনীতি চলত। আর যেহেতু তিনিই তখন মুহতামিম ছিলেন, তাই এর দায়ভারটা তাঁর উপর গিয়ে বর্তে যেত।
রাহমানিয়ায় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট টানাপোড়ন দিনদিন জটিল হতে থাকে। অবশ্য এই জটিলতার আরও খুঁটিনাটি কারণও রয়ছে; তবে মোটাদাগে সৃষ্ট সমস্যার কারণ ছিল—রাজনীতি। বিশেষ করে বিভিন্ন আন্দোলনে গিয়ে যখন রাহমানিয়ার কিছু ছাত্র গ্রেফতার হয়, তখন সমস্যাটা আরও তীব্র হয়ে যায়। এতে মাদরাসার কমিটি শংকিত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে মুফতি সাহেব ছিলেন মাদরাসার সংবিধান অনুসারী। এজন্য কমিটিও তাঁকে সাপোর্ট করত। অন্যদিকে শাইখুল হাদিস সাহেব যে সংবিধান অনুসরণ করতেন না—তা নয়; বরং তিনিও করতেন, তবে তিনি মাদরাসার মুহতামিম হওয়ায় এবং তাঁর পরিচালিত মাদরাসায় তাঁরই গড়া দল—মজলিসের কিছুটা চর্চা হওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তাঁর দিকেই অভিযোগের তির নিক্ষেপ করা হতো! আর এটাই স্বাভাবিক।
তাঁকে নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা দেখতে পেয়ে ১৯৯৯ সালে কমিটির একটি সভায় মাদরাসার ইহতিমামির দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন শাইখুল হাদিস সাহেব; তবে মাদরাসার ‘মুরুব্বি’ হিসেবে থাকবেন বলে আশ্বাস দেন। তখন মাওলানা বাহাউদ্দিন সাহেবকে মুহতামিম বানানো হয়। তখনও শাইখুল হাদিস সাহেবের সাথে কমিটি ও মুফতি সাহেবের সংঘাতটা অনেকটা শিথিল ও নীরব ছিল। যাক, পরিস্থিতি দিনদিন নাজুক আকার ধারণ করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারায় ২০০০ সালে কমিটির একটি সভায় বাহাউদ্দিন সাহেবকে অব্যাহতি দিয়ে মাওলানা হিফজুর রাহমান সাহেবকে মুহতামিম সাব্যস্ত করে কমিটি।
এই ২০০০ সাল থেকেই সংঘাত চরমে পৌঁছায়। কমিটির সাথে শাইখুল হাদিস সাহেবের কঠিন বাকবিতণ্ডা হয়। এতদিনের নীরব বিরোধ এখন প্রকাশ্যে চলে আসে। একদিকে কমিটি ও মুফতি সাহেব এবং তাঁদের সমর্থকগণ এবং অপরদিকে শাখুল হাদিস সাহেব এবং তাঁর সমর্থকগণ। উস্তাদ ও ছাত্রদের মধ্যেও এই বিভাজন পরিলক্ষিত হয়। তাদের মধ্যেও দুই গ্রুপ হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই শাইখুল হাদিস সাহেবের ব্যক্তিত্বের কারণে তাঁর সমর্থকগণের পাল্লা ভারি ছিল। বিবাদ কোনোক্রমে থামছিল না এবং কোনোভাবেই সমঝোতা হচ্ছিল না। কমিটির সাথে শাইখুল হাদিস সাহেবের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়য় হয় এবং এতে করে তাদের সাথে তাঁর সম্পর্কের চূড়ান্ত পর্যায়ের অবনতি ঘটে। এবছর রমজানের পরে মাদরাসা খুলতে তিনি সাফ নিষেধও করেন।
শাইখুল হাদিস সাহেবের কঠিন ভাষা ব্যবহারের কারণে কমিটি তাঁকে মিটিংয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এ ব্যাপারে নিজের বক্তব্য দেওয়ার জন্য আহবান করে। কিন্তু তিনি তাতে সাড়া দেননি। এতে কমিটি আরেকটি মিটিং করে তাঁকে মাদরাসা থেকে ইহতিমামির দায়িত্ব; এমনকী সবকের দায়িত্ব থেকেও স্থায়ীভাবে ‘অব্যাহতি’ প্রদান করে। শাইখুল হাদিস সাহেব রাহমানিয়া মাদরাসা-ছাড়া হয়ে যান। ব্যাপারটা দারুণ আঘাত হানে দেশের উলামা ও তালাবাদের অন্তরে। পরে শাইখ গহরপুরি রহ.-এর অনুরোধে শুধুমাত্র বুখারি শরিফের ক্লাস করানোর জন্য তাঁকে আবারও সসম্মানে বহাল রাখা হয়। ওই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি বুখারি পড়াতে থাকেন।
২০০০ সালের মে মাসে একদল লোক চলে আস মাদরাসার দায়িত্ব নিয়ে নিতে। সামনে ছিলেন শাইখুল হাদিস সাহেব। কিন্তু কমিটির লোকদের কারণে ওইসব লোকেরা মাদরাসার দায়িত্ব নিতে পারেনি। পরে ঢাকার শীর্ষস্থানীয় আলেমদের মাধ্যমে এই বিষয়টার সাময়িক নিষ্পত্তি হয়। এর কিছুদিন পর জুলাইয়ে আবারও একদল লোক এসে মাদরাসার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। কিন্তু এবারও তারা টিকে থাকতে পারেনি; কমিটি ও ছাত্রদের প্রতিবাদের কারণে। এরকম অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি জরুরি মিটিং বসিয়ে শাইখুল হাদিস সাহেব, তাঁর ছেলে, নাতি ও কিছু শিক্ষককে মাদরাসা থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেয়। যেকারণেই হোক; তখনকার ওই দৃশ্যটা খুবই মর্মান্তিক ছিল। শাইখুল হাদিসের মহব্বতে অনেকেই অশ্রুবিসর্জন দিয়েছিলেন।
এরইমধ্যে দেড়টা বছর কেটে যায়। শাইখুল হাদিস সাহেব তাঁর অনুসারীদের নিয়ে পাশে একটি বিল্ডিংয়ে ভাড়া করে মাদরাসা চালাতে থাকেন। ইতিমধ্যে ২০০১ সালের নির্বাচনে চারদলীয় জোট বিজয়লাভ করে। এতে শাইখুল হাদিস সাহেবের দল—খেলাফত মজলিস ছিল অন্যতম শরিক দল। নির্বাচনের কিছুদিন পর নভেম্বরের ৩ তারিখ খেলাফত মজলিসের এমপি মাওলানা শহিদুল ইসলাম সাহেব এবং সদ্য ক্ষমতায় আসা প্রশাসনের জোরে শাইখুল হাদিস সাহেবের সমর্থকগণ রাহমানিয়া মাদরাসাকে নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে নেন। মুফতি মনসুরুল হক সাহেব ও মাওলানা হিফজুর রাহমান সাহেবসহ প্রায় ৩৭ জন উস্তাদকে মাদরাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মূল কমিটিকেও বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়। এই দৃশ্যটাও ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। অশ্রু ঝরানোর মতো।
সেই থেকে নিয়ে গতকাল পর্যন্ত জামিয়া রাহমানিয়া ছিল শাইখুল হাদিস সাহেব ও তাঁর পরিবারের দায়িত্বে। এর ভেতর অনেক বিবাদ হয়েছে। অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গেছে। মামলা-মুকদ্দমা হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৪ সালে আদালত মামলার রায় কমিটি ও মুফতি সাহেবের পক্ষে দিয়েছে। এই রায়ের ওপর পালটা আবেদন করলেও বারেবারে সেটা আদালত খারিজ করে দিয়ে আগের সেই রায়কে বহাল রেখেছে। এরইমধ্যে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মুফতি মনসুরুল হক সাহেব পাশে আলি এন্ড নুর রিয়েল এস্টেটে ভাড়া করে মাদরাসা চালান। এরপর মুহাম্মদপুরেই অদূরে জামিয়াতুল আবরার নামে মাদরাসার দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী ক্যাম্পাস করেন। এরমধ্য দুনিয়া ছেড়ে চলে যান শাইখুল হাদিস সাহেব (নাওয়ারাল্লাহু মারকাদাহ)। যতটুকু জানি, প্রায়ই তিনি স্বীয় ছাত্র মুফতি সাহেবের সাথে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আশেপাশের লোকজনদের কারণে তা পারেননি।
# এই হলো জামিয়া রাহমানিয়া বিভক্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এতেই অনেক লম্বা হয়ে গেছে। বিস্তারিত লিখতে গেলে পুরো একটা বই হয়ে যাবে। চুলচেরা বিশ্লেষণে না গিয়ে আমি মূল মূল পয়েন্টে আলোচনা করেছি। শুধুমাত্র বাস্তবতাটা তুলে ধরার জন্যে। পাশাপাশি অত্যন্ত সযতনে আমাদের সেরেতাজ আকাবির উলামায়ে কেরামদের এই দুঃখজনক মুশাজারাত এর মধ্যে যথাসম্ভব আদব রক্ষা করে শব্দচয়ন করে গেছি। খেয়াল করলে বুঝতে পারবেন। এবার একটু সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করতে চাই—
শাইখুল হাদিস সাহেব যখন রাহমানিয়ার মুহতামিম নিযুক্ত হন, তখন ছিল নব্বুই দশকের শুরু। এই সময়টা ছিল বাংলাদেশে ইসলামি আন্দোলনের এক জাগরণী অধ্যায়। খেলাফত আন্দোলন থেকে বেরিয়ে শাইখুল হাদিস রহ. ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘খেলাফত মজলিস’। বলতে গেলে তাঁর হাতেই নতুন করে মেরুকরণ হয়েছিল বাংলাদেশে দেওবন্দি আলেমদের নেতৃত্বে রাজনীতির প্লাটফর্ম। খেলাফত মজলিস প্রতিষ্ঠার দুবছর পর ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাত্র মজলিস। ব্যস, বানের পানির মতো এগিয়ে যেতে থাকে খেলাফত মজলিস আর ছাত্র মজলিস। কওমি মাদরাসাভিত্তিক পুরোনো সংগঠন—জমিয়ত, নেজামে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলনের প্রভাবিত মাদরাসাগুলোতেও প্রবেশ করে ফেলল শাইখুল হাদিসে দল। কওমি, আলিয়া ও জেনারেল—এই তিন ধারার ছাত্র, শিক্ষক ও ব্যক্তিদের নিয়ে মজলিস চলতে থাকে দুর্বার গতিতে।
এই নব্বুইয়ের দশকে ঘটে বাবরি মসজিদ ধ্বংসবিরোধী ঐতিহাসিক লংমার্চ এবং তসলিমা খেদাও আন্দোলন। এই দুটি আন্দোলন গোটা বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দেয়। দাদাবাবুদের তল্পিবাহক ও নাস্তিকদের ভিত নাড়িয়ে দেয়। এই দুটি আন্দোলনে সিপাহসালারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন শাইখুল হাদিস রহ.। তিনি শুধু কওমি নন; দেশের সকল ইসলামপ্রিয় মানুষের অন্তরে স্থান করে নেন। হাদিসের মসনদের মুকুটহীন সম্রাট হবার পাশাপাশি তখন তাঁর ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা ও পরিচিতি আগের চেয়ে হাজারগুণ বেশি বেড়ে যায়। দেশের সীমানা ছাপিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচিত হয়ে উঠেন।
ঠিক সেই সময়টায় তিনি রাহমানিয়া মাদরাসার শাইখুল হাদিস ও মুহতামিম ছিলেন। যার কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাইখুল হাদিসের নামের পাশাপাশি জামিয়া রাহমানিয়ার নামডাকও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। যদিও লালবাগ মাদরাসার সাবেক উস্তাদদের কারণে এমনিতেই মুহাম্মাদিয়া মাদরাসা এবং পরে রাহমানিয়া মাদরাসার একটা সুনাম ছিল, তবুও শাইখুল হাদিস সাহেবের কারণে রাহমানিয়া মাদরাসার পরিচিতিটা বেশি ব্যাপক হয়। শাইখুল হাদিস সাহেবের আকর্ষণে রাহমানিয়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসতে থাকে দেশের আনাচেকানাচে থেকে ছাত্ররা।
পড়ালেখায়ও রাহমানিয়া দেশের কওমি মাদরাসাগুলোর মধ্যে একটা ঈর্ষণীয় জায়গা দখল করে নিতে সক্ষম হয়। সে সময় সকলেই জামিয়া রাহমানিয়াকে একনামে ‘শাইখুল হাদিসের মাদরাসা’ বলে চিনত। চাঁদা কালেকশনে গেলেও ছাত্ররা ‘আমরা শাইখুল হাদিসের মাদরাসা থেকে এসেছি’ বলে পরিচয় দিত।
সেই সময়েও মুফতি মনসুরুল হক সাহেব রাহমানিয়ার নায়েবে মুহতামিম ছিলেন। শাইখুল হাদিসের পাশাপাশি তিনিও বুখারি আউয়াল পড়াতেন। তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় ওইসব ইমানি আন্দোলনে শরিক থাকতেন। হার লাইনের তাকাযা পূরণের মাদরাসা—জামিয়া রাহমানিয়া বলে তিনি ছাত্রদেরকে নসিহত করতেন। তবে একসময় মুফতি সাহেবের এমন দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যায়। হয়তো বা এতদিন উস্তাদের দলের প্রতি সহানভূতি দেখাতে আগে তিনি এমন ছাড় প্রদান করতেন কিংবা হারদুয়ি হজরতের সান্নিধ্য পেয়ে এসব আন্দোলন থেকে তাঁর মন ফিরে আধ্যাত্মিকতার দিকে চলে যায় অথবা তখনকার সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তিনি তাঁর আগের অবস্থান থেকে ফিরে আসেন—আলাহই ভালো জানেন।
কারণ, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। স্বাভাবিকভাবেই তখন আলেমদের উপর একটা চাপ ছিল। এদিকে শাইখুল হাদিস সাহেবের পরিচালিত মাদরাসা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই সেখানে গোপনে ছাত্র মজলিসের কিছুটা চর্চা হতো। অনেক ছাত্র মিছিল, মিটিং ও আন্দোলনে শরিক হতো। এতে কোনো কোনো উস্তাদেরও ভূমিকা ছিল। বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্ররা গ্রেফতারও হতো। ভেতরে খুব একটা রাজনীতি চর্চা না হলেও একেবারে হতো না—এটা অস্বীকার করার কোনো উপায়ই ছিল না। তা ছাড়া জামিয়া রাহমানিয়াকে বাইরে সকলেই ‘মজলিসের স্বর্গরাজ্য’ মনে করত। কমিটি শাইখুল হাদিস সাহেবকে সম্মানার্থে কিছু বলতে না পারলেও এসব আন্দোলন-রাজনীতি পছন্দ করত না।
জামিয়া রাহমানিয়ার ভিত্তি যদিও মুফতি মনসুরুল হক সাহবের হাতে হয়েছে এবং তিনিই এ জামিয়ার ভাঙাগড়ার কারিগর, কিন্তু জামিয়া রাহমানিয়ার আজকের এই প্রসিদ্ধি ও পরিচিতিটা বেশিরভাগই হয়েছে শাইখুল হাদিস আজিজুল হক রহ.-এর মাধ্যমে। তাঁর ইলমি মাকাম, ব্যক্তিত্ব, আদর্শ, পরিচিতি, গ্রহণযোগ্যতা ও গগনচুম্বী জনপ্রিয়তাই রাহমানিয়াকে আহলে ইলম ছাড়াও সাধারণ মুসলমানদের অন্তরে জায়গা করে দিয়েছে। এই পরিচিতিটা শুরু হয়েছে নব্বুই দশক থেকে, বেগবান হয়েছে ২০০১ সালের পর তাঁর জীবদ্দশাতে; এবং এরপর অদ্যাবধি তাঁর সুযোগ্য সন্তান মাওলানা মাহফুজুল হক দা.বা.-এর হাত ধরে। কারণ, রাহমানিয়ার ৩৩ বছরের ইতিহাসে ইহতিমামির বেশিরভাগ সময় খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন শাইখ এবং তাঁর পরিবার। এজন্য রাহমানিয়ার আজকের পরিচিতির পেছনে বেশিরভাগ অবদান শাইখের পরিবারের—এটা অনস্বীকার্য।
কিন্তু রাহমানিয়া প্রতিষ্ঠার শুরুলগ্ন, প্রেক্ষাপট, ত্যাগ ও ভূমিকার দিকে তাকালে মুফতি সাহবের অবদানের কথা ভুলবার নয়। বরং তাঁর এই অবদানটাই মূল ও মুখ্য। একটা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতির আগে তার প্রতিষ্ঠার কথা অবশ্যই ধর্তব্য। এটা স্বীকার না করলে বে-ইনসাফি হবে। প্রতিষ্ঠান না থাকলে পরিচিতিটা কোত্থেকে আসত? তা ছাড়া ২০০১ সালে মুফতি সাহেবদেরকে সরিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তো মাদরাসার পেছনে মুফতি সাহেবের অবদানটা মোটেও কম নয়; তিনি মুহতামিম না হলেও নায়েবে মুহতামিম থেকে কার্যকরী ভূমিকাটা তিনিই রেখেছেন। সে হিসেবে রাহমানিয়ার পরিচিতি গড়ার ক্ষেত্রে তিনি মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন।
# এখানে সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার যেটা, সেটা হলো যে, জামিয়া রাহমানিয়া ওয়াকফ সম্পত্তি। শাইখ নুরুদ্দিন গহরপুরি রহ.-এর অনুরোধে আলি ও নুর—দুভাই মাদরাসার জায়গাকে ওয়াকফ করে দিয়েছেন। তখন এই ওয়াকফ সম্পত্তির ‘মুতাওয়াল্লি’ ছিলেন হাজি আবদুল মালিক সাহেব। আর ওয়াকফের ক্ষেত্রে মাসআলা হলো, ওয়াকফকৃত সম্পত্তি ওয়াকিফ এর মালিকানা থেকে বেরিয়ে আল্লাহর মালিকানায় চলে যায়। এতে ওয়াকফ সম্পত্তির কোনো মুতাওয়াল্লি থাকলে এই ওয়াকফ সম্পত্তিটি মুতাওয়াল্লির তত্বাবধানে পরিচালিত হবে, আর না থাকলে ওয়াকিফ এর পরিবারের তত্বাবধানে পরিচালিত হবে। আর এটা সবাই জানে যে, ওয়াকফের মুতাওয়াল্লি ও মূল কমিটি আজও পর্যন্ত মুফতি সাহেবের সাথেই রয়েছে।
রাহমানিয়ায় রাজনীতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঝামেলার সময় মুতাওয়াল্লি ও কমিটি সবসময় মুফতি সাহেবের পক্ষে ছিল। এজন্য ২০০০ সালে তারা শাইখকে অব্যাহতি দিয়ে মুফতি সাহেবের হাতেই মাদরাসার দায়িত্ব দেয়। কিন্তু ২০০১ সালের ওই দুঃখজনক ট্র্যাজেডিতে মুফতি সাহেবদের সরিয়ে এবং মুতাওয়াল্লি ও কমিটিকে বাজেয়াপ্ত করার সম্ভবত কোনোই সুযোগ ছিল না শরিয়তে। এটা বিজ্ঞ উলামা ও মুফতি সাহেবানরা ভালো বলতে পারবেন।
এজন্যই মুতাওয়াল্লি ও কমিটি আজও পর্যন্ত রাহমানিয়া মাদরাসার পেছনে লেগে আছেন। তারা এই ওয়াকফ সম্পত্তিকে শাইখের পরিবারের কর্তৃত্বে রাখতে নারাজ। এজন্যই এত মামলা-মুকদ্দমা। তাদের এই শক্ত দলিল থাকার কারণেই ওয়াকফ এসোসিয়েশনও মামলার রায় তাদের পক্ষে দেয়। এ কারণেই এ রায়ের বিরুদ্ধে পাল্টা আপিল করেও রায়কে নড়চড় করা যায়নি। আর জেনে রাখা ভালো, এইসব মামলা-মুকদ্দমা চালিয়ে আসছেন স্বয়ং মুতাওয়াল্লি ও কমিটি। মুফতি সাহেব তাদের সাথে আছেন।
# কিন্তু বর্তমানের এই নাজুক মুহূর্তে এসে ২০১৪ সালে পাওয়া মামলার রায়কে কার্যকর করার কারণে আমরা একটু বেশিই ব্যতিত হচ্ছি। স্বভাবতই শাইখের ফ্যামিলির প্রতি সহানুভূতিশীল হচ্ছি। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই ভালোবাসা ও ভক্তি আর অধিকার ও ইনসাফ এক নয়। এখন প্রশ্ন আসে—তাহলে এতদিন কেন মাদরাসা নিয়ে যাওয়া হলো না? এর নানা কারণ থাকতে পারে। মাদরাসায় শাইখের পরিবারের শেকড়টা খুবই গভীরভাবে প্রোথিত ছিল। চাইলেই মামলা রায় অনুসারে মাদরাসা নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এতে বিরাট ফিতনা হতো। কিন্তু বর্তমানে খোদ হুকুমতই নিজ স্বার্থে এগিয়ে এসেছে। মাদরাসার মালিকানা উদ্ধার করেছে। এই সুযোগটা গ্রহণ করেছে মুতাওয়াল্লি ও কমিটি। মুফতি সাহেব তাদের সাথে আছেন শুধু। বাংলা ট্রিবিউনসহ বিভিন্ন নিউজ পোর্টালের রিপোর্ট দেখলে বুঝতে পারবেন—এখানে গরজ কার বেশি! মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি—ব্যাপারটা এরকমই। সব কথা বলা লাগে না; বুঝে নিতে হয়।
শেষকথা, মাদারিসে কওমিয়াতে এরকম দায়িত্বশীলদের পালাবদল নয়া নয়; এটির ধারাবাহিকতা খোদ দারুল উলুম দেওবন্দ ও মাজাহিরে উলুম সাহারানপুর থেকে। আমাদের দেশে লালবাগ মাদরাসা, যাত্রাবাড়ি মাদরাসা, বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার এবং সম্প্রতি বারিধারা মাদরাসার ব্যাপারটা জানলে অনেক কিছুই উপলব্দি করতে পারবেন। তাই বলে এসব দীনি দরসগাহ থেমে থাকেনি। যারাই এসেছেন, তাদের দ্বারা দীনের খেদমত অব্যাহত রয়ছে। রাহমানিয়াতেও এরকমভাবে দীনের খেদমত জারি থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু আমরা অযথাই জবানদারাজি করে আমাদের নসিব খারাপ করছি!সে জন্য বড়দের ব্যপারে আমাদের জবান এবং দিল উভয়টাই পাক থাকা দরকার নিজেদের হেফাজতের জন্য।আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকেই নিজ গুনে ক্ষমা করে এবং এখলাসের সাথে সকল কাজ করার তৌফিক দান করুন।আমিন,ইয়া রব্বিল আলামিন।
( কপি-পেস্ট পোস্ট)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন