কোরআন হাদীসের আলোকে জীবন

 সালাত আদায়ের জন্য যদি কিবলার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া না যায়, তাহলে অনুমানে যে কোন দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা যাবে। আর আল্লাহ তো সর্বত্রই বিরাজমান। তবে সালাত আদায় করতে হবে খুবই ধীরস্থিরভাবে ও মনোযোগ সহকারে। দাড়ান অবস্থায় দৃষ্টি থাকতে হবে সিজদার সময় যেখানে কপাল ঠেকবে ঠিক সে স্থানে, আর রুকূর সময় দৃষ্টি থাকবে দু’পায়ের সম্মুখ ভাগে। ডান বাম অথবা উপরের দিকে তাকানো যাবে না। অনুরূপভাবে অহেতুকভাবে নড়াচড়া বা আগ-পিছ করা যাবে না। সর্বক্ষণ স্থির থাকতে হবে, রুকূ-সিজদায় যেতে হবে নির্ধারিত ভঙ্গিমায়। দৈনন্দিন জীবনের পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরযে আইন। পূর্ণবয়স্ক প্রতিটি মানুষের জন্য এটা ফরয। আর জানায়ায় সালাত ফরযে কিফায়া। সমাজের কিছু সংখ্যক লোক এ সালাত আদায় করলে অন্যদেরটা আদায় হয়ে যায়। আর কেউ যদি এ সালাত না পড়ে তাহলে সমাজের সবাইকে গুনাহগার হতে হয়। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত অপেক্ষা জানাযার সালাত খানিকটা ভিন্নতর। জানাযায় সালাতেও ওযু করতে হয। কিবলামুখী হতে হয়, নিয়ত করতে হয়, সূরা-কিরাত পড়তে হয়। কিন্তু এখানে রুকূ-সিজদায় যেতে হয় না, বা তাশাহুদের ভঙ্গিমায় বসতে হয় না। সালাত আদায় করতে হয় চার তকবীরে। প্রথমে আল্লাহু আকবর বলার পর সানা, সূরা ফাতিহা ও অন্য যে কোন একটি সূরা তিলাওয়াত করতে হয়। দ্বিতীয় তকবীরের পর নবী করীম (সা.)-রে উপরে দরূদ পাঠ ও সমস্ত মু’মিন মুসলমানের জন্য মুনাজাত করা হয়। তৃতীয় তকবীরের পর মৃত ব্যক্তির জন্য বিশেষ মুনাজাত করা হয়। চতুর্থ তকবীরের পর সালাম ফিরিযে জানাযার সালাত শেষ করতে হয়। কেউ অসুস্থ ও শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে এবং দাড়িয়ে সালাত আদায় করতে সমর্থ না হলে সে তার সুবিধা অনুসারে বসে বা শুয়ে সালাত আদায় করবে। শুয়ে সালাত আদায় করার সময় সে নিয়ম মাফিক সূরা-ক্বিরাত ও দোয়া দরূদ পাঠ করবে। আর কল্পনায় রুকূ-সিজদায় যাবে। তাতেই তার সালাত আদায় হয়ে যাবে। অসুস্থ এবং শয্যাশায়ী অবস্থায় একজন মুসলমান বসে এমনকি শুয়েও নামায আদায় করতে পারে। বসে নামায পড়ার সময় সে এমনভাবে রুকূতে যাবে যাতে কপাল পানি স্পর্শ না করে। যদি শুয়ে শুয়ে নামায পড়তেই হয়, তাহলে সে পর্যায়ক্রমে দাড়ান, রুকূ, সিজাদ ও তাশাহুদের কথা স্মরণ করবে। আর বিভিন্ন পর্যায়ে যে সমস্ত দোয়া-দরূদ তেলাওয়াত করতে হয়, মনে মনে সেগুলি তেলায়াত করতে হবে। তাতেই তার সালাত আদায় হয়ে যাবে। কেউ যখন সফরে থাকে তখন সে চার রাক’আতের পরিবর্তে দুই রাক’আত ফরয পড়ে থাকে। আবার বিশেষ পরিস্থিতে সময়ের স্বল্পতা বা প্রচন্ড চাপের মুখে থাকলে দু’ওয়াক্তের সালাতকে একত্রে আদায় করতে পারে। যেমন দুপুর থেকে সূর্যাস্তের মধ্যে যে কোন সময় যোহন ও আছর এর মাগরিব ও ইশার সালাত একত্রে আদায় করা যায়। হজ্জের সময় আরাফাতে ও মুজদালিফায় এ ভাবে সালাত আদায় করতে হয়।

মাযহাব : ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বিভিন্নতা ক্ষেত্রে মুসলমাদের মধ্যে প্রধানত তিনটি সম্প্রদায় রয়েয়ে-সুন্নী, শিয়া ও খারিজী। সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে আবার বিভিন্ন দল বা মাযহাব রয়েছে। যেমন সুন্নীদের মধ্যে রয়েছে চারটি মাযহাব : হানাফী, শাফী, মালেকী ও হাম্বলী। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা মাযহাবের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ বা আচরণ ও অনুষ্ঠাগত বৈষম্য ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। এখানে শুধু এটুকুই বলে রাখা যথেষ্ট যে নেতৃস্থানীয় ফকীহ ও মুজতাহিদগণ তাদের নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে নবী করীম (সা.) এর বাণী ও আচার-আচরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। আমল করেছেন তদনুসারে। এখান থেকেই ফকীহগণের মধ্যে এক একটি মতের সূত্র পাত ঘটে। ধর্ম বিশারদগণের অনুসারীদের নিয়ে গড়ে উঠে এক একটি মযহাব। বস্তুতপক্ষে কোন সম্প্রদায় বা মাযহাবেই নতুন কোন ধর্মবিশ্বাস বা আচারণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেনি। সকল সম্প্রদায়ের বা মাযহাবের ভিত্তিমূলে রয়েছে হাদীস। কখনো কখনো নবী করীম (সা.) নিজেই বিশেষ কোন কাজ বা কাজের ধারাকে পাল্টে ফেলতেন। কখনো এ পরিবর্তন সম্পর্কে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতেন। যেমন-গোড়ার দিকে সালাতে রুকূ করার সময় তিনি দুটি হাত নিচের দিকে সোজা ঝুলিয়ে রাখতেন। কিন্তু পরবর্তীতে হাত দুটি হাটুর উপর রাখতে শুরু করেন। এবং হাত ঝুলিয়ে রাখার বিধান বাতিল বলে ঘোষণা দেন। কখনো আবার এ জাতীয় পরিবর্তন সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতেন। নবী করীম (সা.) এর কোন কোন আমল বা কাজের সম্মতি সম্পর্কে আলোচনা উত্থাপিত হয় নবীজীর ওফাতের কয়েক পুরুষ পরে। তখন ধর্ম-বিশারদগণের মধ্যে দেখা দেয় মতপার্থক্য। এখান থেকেই সৃষ্টি হয় দল-উপদলের। অর্থাৎ সুন্নতের বিভিন্নতার সূত্র ধরেই ফকীহগণের মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। আর সে কারণেই কোন সম্প্রদায়ের জন্য অন্য সম্প্রদায়ের মতবাদকে উপেক্ষা করার অধিকার নেই। এখানে বলে রাখা আবশ্যক যে কোন একটি কাজ নবী করীম (সা.) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সম্পন্ন করলেও কখন কিভাবে পরিবর্তন করেছেন, সবক্ষেত্রে তার ধারাবাহিক কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। যদি থাকত তা হলে স্বাভাবিক নিয়মেই পরের নিয়ম দিয়ে পূর্বের নিয়ম বাতিল হয়ে যেত। ফলে নবী করীম (সা.) একবার যে নিয়মটি পালন করেছেন, যেটার ব্যাপারে তিনি কখনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন নি, সেটাও একটা সুন্নত। আর এ সবকিছু মিলেই গড়ে উঠেছে উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য নিয়ম-কানুন। নবী করীম (সা.) এর যতগুলো উপাধি আছে তার মধ্যে একটি হল হাবীবুল্লাহ, অর্থাৎ আল্লাহর বন্ধু। কুরআন মজীদে আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মধ্যে রয়েছে অনুকরণীয় সর্বোত্তম আদর্শ (৩১ : ২১)। এ আয়াতের ব্যাখায় বলা যেতে পারে, আল্লাহ তা’আলা আশা করেন যে, মুসলমানরা প্রিয় নবী (সা.) এর সমস্ত আচার-আচরণের উপর আমল করবে। এমনকি তিনি অনিয়মিতভাবে যে কাজ করেছেন, অর্থাৎ শুরুতে যা করেছেন কিন্তু পরে করেননি, অথবা শুরুতে করেননি, কিন্তু পরে করেছেন তার কোনটাই বাদ যাবে না। এভাবেই মুসলমানরা একই কাজ বিভিন্ন ভাবে সম্পন্ন করবে, কিন্তু তাদের কোনটাই সুন্নতের বাইরে যাবে না। আল্লাহ তা’আলা যে বিভিন্ন সম্প্রদায় বা মাযহাব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নবী করীম (সা.)-এর সমস্ত কাজকে একটি স্থায়ী রূপ দিয়েছেন। আর সে কারণেই সমস্ত মাযহারে মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। কেউ কারো প্রতি অসুহিষ্ণু হতে পরে না।
সালাতের আরবির ব্যবহার : এটা জানা কথা যে, মুসলমানরা আরবি ভাষায় সালাত আদায় করে থাকে। তাদের দোয়া-দরুদ পাঠ, কুরআন তিলাওয়াত, তাসবীহ-তাহলীল সব কিছুর ভাষা রীতি আরবি। আরব-অনারব, এমনকি যে সমস্ত এলাকার মুসলমান আরবি জানে না বা বোঝে না, তাদেরও সালাতের ভাষা আরবি। নবী করীম (সা.) এর আমলে এ নিয়মটি চালু ছিল। চৌদ্দ শ’ বছর পর এখনও এ নিয়ম অব্যাহত রয়েছে। কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে। জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি। আপাত দৃষ্টিতে এটাকে খুবই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মনে হবে যে, একজন লোক যে ভাষা বোঝে, সে ভাষাতেই আল্লাহ তা’আলার দরবারে আবেদন-নিবেদন জানাবে। আর এটা জানা কথা যে, মাতৃভাষাই হল ইবাদত-বন্দেগী করবার ও তাসবীহর উত্তম মাধ্যম। সুতরাং এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, একজন মুসলমান যে ভাষায় কথা বলে সেটাই হবে তার সালাতের ভাষা। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সাধারণ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করলে এ ধরনের যুক্তির অসারতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
প্রথমেই আসে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। কুরআনুল করীমের বর্ণনা অনুসারে, নবী করীম (সা.) এর পবিত্র স্ত্রীগণকে বলা হয় উম্মুল মু’মিনীন। অর্থাৎ মু’মিনদের মাতা। তাঁদের সবারই মুখের ভাষা ছিল আরবি। সে বিবেচনায় সকল মুসলমানের মাতৃভাষাও আরবি। সুতরাং মাতৃভাষায় দোয়া-দরূদ তাসবীহ-তাহলীল পাঠ করতে আপত্তি উঠবে কেন? কারো কারো জন্য এ যুক্তি পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। তাদের জনা আবশ্যক যে, ইসলামী আকীদা অনুসারে কুরআন হল আল্লাহর কালাম। কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলত অনেক। নফল ইবাদতের মধ্যে এটা সর্বোত্তম ইবাদত। কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে একজন মুসলমান মূলত আল্লাহ তা’আলার সান্নিধ্যে পৌছে এবং এটাই একজন মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্য। এটা যেন আল্লাহর দরবারে পৌছার একটি পথ। বৈদ্যুতিক তারের মধ্য দিয়ে বাল্বে যেভাবে আলো সঞ্চারিত হয় এও যেন ঠিক তাই। যারা অধিকতর বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন তাদের জন্য বলা আবশ্যক যে, দোয়া হল আল্লাহ তা’আলার দরবারে আবেদন-নিবেদন করার একটা মাধ্যম। এটা একজনের একান্ত নিজস্ব ও ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে কোন ভাষায় বা ভঙ্গিমায় আল্লাহর কাছে নিবেদন করা যায়। এমনকি দোয়া বা মুনাজাতে ব্যক্তি যা ইচ্ছা তাই চাইতে পারে। এ ব্যাপারে তার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে বান্দা এককভাবে স্রষ্টার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। আর সালাতের বিষয়টি এর ঠিক উল্টো। এখানে আল্লাহ তা’আলার হক আদায় করার ব্যাপারটা মুখ্য। এটা আদায় করতে হয় সম্মিলিতভাবে, জামাআত সহকারে। ফলে সালাতে কেউ নিজস্ব পসন্দ অনুসারে চলতে পারে না। সালাতের নিজস্ব একটি ভঙ্গিমা ও পদ্ধতি রয়েছে। রয়েছে আরকান-আহকাম। জামাআতে ফরয আদায় করা একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে অধিক সাওয়াবের। যদি ইসলাম বিশেষ কোন অঞ্চল, গোত্র বা জাতির জন্য নির্ধারিত হত, তাহলে মুসলমানরা অবশ্যই আঞ্চলিক, জাতীয় বা গোত্রীয় ভাষায় ধর্ম চর্চা করতে পারত। কিন্তু ইসলাম একটি সার্বজনীন ও চিরন্তন ধর্ম। ইসলামের আবেদন বিশেষ কোন অঞ্চল গোত্র বা কালের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। বরং মুসলমানরা অংসখ্য ভাষায় কথা বলে। তারা বসবাস করে বিভিন্ন গোত্র ও অঞ্চলে। বর্তমান সময়ে আমাদের জীবন অধিকতর বিশ্বজনীনতা লাভ করেছে। বর্তমান বিশ্বের প্রায় সবগুলো শহরেই মুসলমানদের সাক্ষাৎ মেলে। তারা সে সমস্ত শহরের স্থায়ী অধিবাসী অথবা সফরকারী যেভাবেই থাক না কেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি অবশ্যই দৃষ্টি দিতে হবে। ধরে নেই যে, একজন ইংরেজ চীনদেশ সফরে গেল। চীনা ভাষায় একটি অক্ষরও সে বুঝে না। পথ চলতে চলতে হঠাৎ করেই সে শুনতে পেল ‘চিং চ্যাং চাং’-স্বাভাবিকভাবেই সে এর অর্থ বুঝেবে না। এর কারণও জানতে পারবে না। আর এটা যদি ‘আল্লাহু আকবর’ শব্দের আঞ্চলিক পরিভাষা হয় তাহলে হয়ত সে শুক্রবারের জুম’আর নামায থেকে বঞ্চিত হবে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পাহাড়পুর রচনা

সোনারগাঁও রচনা

প্রতীক, সংকেত, যোজনী