বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে নফল নামাজ
নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় রোকন এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। মুসলমান তার প্রয়োজন মেটানোর জন্য মহান আল্লাহর কুদরতি পায়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিস্থিতি ও দুর্যোগের সময়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার নফল নামাজ। জেনে নিই এসব নামাজের বিষয়ে...
ইস্তিস্কা নামাজ
ইস্তিস্কা শব্দের অর্থ পানি প্রার্থনা করা। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ার
কারণে খরা শুরু হয়, এতে মাঠে ফসল ফলে না; খাল–বিল, নদী–নালা, পুকুর শুকিয়ে
যায়, জীবজন্তু ও মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। এই অবস্থায় বুঝতে হবে
মানুষের গোনাহের কারণে আল্লাহ পাক নারাজ হয়েছেন। সুতরাং আল্লাহ তাআলার
কাছে খাস তাওবা করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আকুতিভরে বৃষ্টির জন্য
প্রার্থনা জানাতে হবে। এই নামাজকে ইস্তিস্কার নামাজ বলে। ইস্তিস্কার নামাজ
হচ্ছে সুন্নত নামাজ; পরপর তিন দিন ইস্তিস্কার নামাজ পড়া সুন্নত। যদি
ইতিমধ্যে বৃষ্টি হয়েও যায়, তবু তিন দিন পুরো করা উত্তম। এই তিন দিন নফল
রোজা রাখা মোস্তাহাব।
এই নামাজ পড়ার আগে সবাইকে নিজ নিজ গোনাহের জন্য খাস তাওবা করা, পাওনাদারের
পাওনা মিটিয়ে দেওয়া ও গরিব-মিসকিনদের দান-খয়রাত করা আবশ্যক। সব বয়সের
মোমিন পুরুষ একত্র হয়ে খোলা মাঠে হাজির হবেন। সবাই খালি পায়ে, সাধারণ
পোশাকে, হেঁটে ময়দানে যাবেন। এই নামাজের জন্য কোনো আজান, একামত নেই। এই
নামাজ জামাতে পড়তে হয়। ইমাম সশব্দে কিরাআত পড়বেন। নামাজ শেষে ঈদের নামাজের
মতো দুটি খুতবা দেবেন। খুতবা প্রদানের সময় ইমাম মিম্বরে দাঁড়াবেন না, বরং
সমতলে দাঁড়িয়েই এই খুতবা দেবেন। খুতবা শেষে সবাই কিবলামুখী হয়ে বসে, ইমাম
কিবলামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত কাকুতি–মিনতিসহকারে চোখের পানি ফেলে ভয় ও
আশা নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বৃষ্টির জন্য নির্ধারিত দোয়া পাঠ করবেন। ইমাম ও
মুসল্লি সবাই উভয় হাত মাথা বরাবর তুলে মোনাজাত করবেন। (বুখারি: ১০২৪)।
সূর্যগ্রহণ (কুছুফ)-এর নামাজ
সূর্যগ্রহণের সময় এই নামাজ ময়দানে বা মসজিদে জামাতের সঙ্গে পড়া সুন্নত।
সুরা ফাতিহার পর দীর্ঘ সুরা পড়া, নিঃশব্দে কিরাআত পাঠ করা এবং রুকু ও সিজদা
অবস্থায় বেশি সময় কাটানো এই নামাজের সুন্নত। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব
মোনাজাত করবেন এবং মুক্তাদিগণ ‘আমিন’ বলবেন। সূর্য গ্রহণমুক্ত না হওয়া
পর্যন্ত এই মোনাজাত চলতে থাকবে। তবে কোনো নামাজের ওয়াক্ত হলে মোনাজাত শেষ
করা যাবে। জামাতে পড়া সম্ভব না হলে একাকীও এই নামাজ পড়া যায়। নারীরাও এই
নামাজ বাড়িতে পড়তে পারবেন। নামাজ শেষে গ্রহণমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত
দোয়া-দরুদ পাঠ, কোরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিতে মশগুল থাকবেন; এটাই সুন্নত।
(বুখারি: ১০৪২, ১০৫১, ১০৫২; মুসলিম: ৯০১, ৯০৭; আহমাদ: ২৭১১, ৩৩৭৪, ৫৮৮৭;
ইবনে মাজাহ: ১২৬১; নাসায়ি: ১৪৫৯; আবু দাউদ: ১১৭৭; মুস্তাদরাকে হাকিম: ১২৩১;
জদুল মাআদ, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১২৪)।
চন্দ্রগ্রহণ (খুছুফ)-এর নামাজ
চন্দ্রগ্রহণের সময় দুই রাকাত নামাজ পড়া সুন্নত। এই নামাজ একাকী নিজ নিজ
ঘরে পড়া উত্তম। সুরা ফাতিহার পর দীর্ঘ সুরা পড়া, নিঃশব্দে কিরাআত পাঠ করা
এবং রুকু ও সিজদা অবস্থায় বেশি সময় কাটানো এই নামাজের সুন্নত। নারীরাও এই
নামাজ পড়তে পারবেন। নামাজ শেষে চন্দ্র গ্রহণমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত নামাজ,
দোয়া–দরুদ পাঠ, কোরআন তিলাওয়াত ইত্যাদিতে মশগুল থাকবেন; এটাই সুন্নত।
(বুখারি ও মুসলিম)।
সালাতুত তাসবিহ
সালাতুত তাসবিহ চার রাকাত। এই নামাজ আদায় করতে ‘সুবহানাল্লাহি, ওয়াল
হামদুলিল্লাহি, ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ এই তাসবিহ চার
রাকাতে মোট ৩০০ বার পড়তে হয় বলে এই নামাজকে সালাতুত তাসবিহ বলে। এই নামাজের
ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘নবী করিম (সা.) একবার তাঁর চাচা
হজরত আব্বাস (রা.)-কে বললেন, “চাচাজান, আমি কি আপনাকে এমন একটা কাজের
সন্ধান বলে দেব, যা পালন করলে আল্লাহ তাআলা আপনার আগের এবং পরের নতুন ও
পুরোনো, ইচ্ছাকৃত ও অনিচ্ছাকৃত, প্রকাশ্য এবং গোপনীয়, ছগিরা এবং কবিরা সব
গোনাহ মাফ করে দেবেন? আর সেই কাজটি হলো এই যে আপনি চার রাকাত সালাতুত
তাসবিহ পড়বেন। সম্ভব হলে প্রতিদিন একবার করে এই নামাজ পড়বেন। যদি তা না
পারেন প্রত্যেক জুমার দিন একবার এই নামাজ পড়বেন। আর যদি তা–ও না পারেন,
বছরে একবার পড়বেন, আর তা–ও যদি না হয় তবে সারা জীবনে মাত্র একবার হলেও
পড়বেন”।’ (তিরমিজি)।
ইস্তিখারার নামাজ
কোনো জায়েজ বিষয়ে একাধিক পন্থা থাকলে এর মধ্যে কোনো একটিকে নির্ধারণের
জন্য দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে বিশেষ দোয়ার মাধ্যমে ভালো-মন্দ দিকনির্দেশনা
লাভ করা যায়। এই নামাজকে ইস্তিখারার নামাজ বলে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ইস্তিখারা করা অতি সৌভাগ্যের বিষয়। তিনি
সাহাবিদের ইস্তিখারা শিক্ষা দিতেন। হজরত আলী (রা.) বলেছেন, স্বপ্নে কোনো
বিষয়ের ভালো-মন্দ জানতে হলে ইশার নামাজের পর, শোয়ার আগে দুই রাকাত নফল
নামাজ পড়ে, কয়েকবার দরুদ শরিফ পড়ে তারপর ইস্তিখারা নামাজের জন্য নির্ধারিত
দোয়া পড়ে পবিত্র শরীরে অজুসহ পবিত্র বিছানায় ঘুমাবে। ইনশা আল্লাহ স্বপ্নে
সে বিষয়ে নির্দেশনা লাভ করবে, যাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। এভাবে এক দিনে
স্থির করতে না পারলে তিন দিন বা সাত দিন আমল করবে। এরপরও যদি কোনো
সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না হওয়া যায়, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে কোনো একটি কাজ
করবে; তাতেই বরকত হবে।
লেখক: মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী; যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ
জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন