
চন্দ্র বর্ষের নবম মাস
রমযান। রমযান শব্দটি ‘রম্যুন’ শব্দমূল হতে উদ্ভুত। অর্থ উত্তপ্ত ভূমিতে
চলার ফলে পায়ে ফোসকা পড়া, কোন বস্তুকে জ্বালিয়ে ভস্ম করা। আরবী ‘সাওম’,
শব্দটি বাবে নাসারা-এর মাসদার। আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, চুপ থাকা, বন্ধ
করা, আত্মসংযম ইত্যাদি। (লিসানুল ‘আরব, ৭ম খ-, পৃ. ৪৪৬; বাযলুল মাজহুদ, ১১শ
খ-, পৃ. ৮৯)। ইমাম রাগিব আল-ইস্পাহানী (র.) বলেন, ‘বিশেষ কাজ থেকে বিরত
থাকাকেই সাওম বলা হয়’ (আল-মুফরাদাত ফী গারীবিল কোরআন, পৃ. ২৯৩)। শরীআতের
পরিভাষায় সুবহে সাদিকের পূর্ব থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সাওয়াব ও
আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের আশায় সকল প্রকারের পানাহার ও জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত
থাকার নাম সাওম ফার্সী ভাষায় রোযা।
বদরুদ্দীন আল-আয়নী (র.) বলেন, ‘শরীআতের পরিভাষায় সুবহে সাদিক উদিত হওয়া
থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার, স্ত্রী সহবাস ও সংশিষ্ট বিষয় থেকে বিরত
থাকাকেই সাওম বলে’ (‘উমদাতুল কারী, ১০ম খ-, পৃ. ৬০৩)। ড. ইউসুফ হামিদ
আল-আলাম বলেন, ‘সিয়াম সাধনা হলো দু’টি কামনার চাহিদা থেকে বিরত থাকা, পেটের
কামনা ও যৌন কামনা। রোযার উপাকারিতা হলো মানুষের ইচ্ছা শক্তিকে সংকল্প
গ্রহণের উপর ট্রেনিং দেয়া, স্বাদ গ্রহণের উপর উচ্চাসন দান করা, পার্থিব বৈধ
বস্তুর মোহনীয় তা থেকে মহান রবের প্রতি অনুগত হওয়ার প্রশিক্ষণ। প্রথম
পদ্ধতি হলো তাক্ওয়া অর্জনের জন্য নিষিদ্ধ কার্যাবলী পরিহার করার ইচ্ছা করা,
আর তাক্ওয়াই আল্লাহ্ পাকের নৈকট্যে ও অনুগত করতে সক্ষম। সুতরাং সিয়াম
সাধনা তাক্ওয়ার বাহন, তাক্ওয়াই আল্লাহ্ তাআলার আনুগত্যের দিকে তার হুকুম
মেনে নিষেধসমূহ বর্জন করিয়ে অগ্রসর করতে সহায়ক। এজন্য মুত্তাকী ব্যক্তিকে
নামায, যাকাতসহ অন্যান্য ওয়াজিব ও নফল ইবাদত আদায় করতে সহজ করে দেয়।’
(আল-মাকাসিদুল আম্মাহ্ লিশ্-শারীআতিল ইসলামিয়্যাহ্, পৃ. ২৪৩-২৪৪)।
রমযান মাসে দিনের বেলায় সকল প্রকার পানাহার ও ইন্দ্রীয় কার্যাবলী থেকে বিরত
থাকার কারণে মানব দেহে এক প্রকার দাহ ও জ্বলনের সৃষ্টি হয়। এ গাত্রদাহ ও
অন্তরদাহকে সম্বল করে মহান আল্লাহ্ বান্দার পাপরাশিকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে
দেন ও ক্ষমা করে দেন। রাসূলুলাহ্ (সা.) এ সম্পর্কে বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও
ইহ্তিসাবের সাথে রমযানের রোযা রাখবে তার অতীতের সকল গোনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া
হবে’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৭৬৮; সুনানুন্-নাসাঈ, হাদীছ ২১৬৪; মুসনাদু
আহমাদ, হাদীছ নং ৮২২২)। মাহে রমযান আমাদেরকে বহু বিষয়ে শিক্ষা দেয়। এ
শিক্ষাগুলো যদি নিজেদের জীবনে, পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গ্রহণ
করি তাহলে আমরা প্রকৃত মুমিন হিসেবে দিক্ষা লাভ করতে পারবে। নি¤েœ মাহে
রমযানের শিক্ষা সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো,
মাহে রমযান তাক্ওয়া শিক্ষা দেয়
মাহে রমযানের প্রথম ও মূল শিক্ষা হলো তাক্ওয়া। রযমান আমাদের তাক্ওয়ার গুণে
গুণান্বিত করে। উন্নীত করে আমাদের মুত্তাকীর স্তরে। তাক্ওয়া শব্দের
আভিধানিক অর্থ ভয়, ভীতি, পরহেযগার, বিরত থাকা, রক্ষা করা ইত্যাদি। ইসলামী
শরীআতের পরিভাষায় তাক্ওয়া হলো, একমাত্র আল্লাহ্র ভয়ে যাবতীয় অন্যায় কাজ
থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
মাহে রমযান এসেছে রহমত, মাগফেরাত ও মুক্তির সাওগাত নিয়ে। আত্মসংযম,
আত্মনিয়ন্ত্রণ, আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন এবং তাক্ওয়া প্রশিক্ষণ গ্রহণের
নিমিত্তে এ মাসের সিয়াম সাধনা ফরয করা হয়েছে। মাহে রমযান আমাদের এ তাক্ওয়া
অর্জনের প্রশিক্ষণ দেয় পুরো একটি মাস পর্যন্ত। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘হে
ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের
পূর্ববতী উম্মতগণের উপর। আর আশা করা যায়, এতে তোমরা তাক্ওয়া অর্জন করবে।’
(সূরা আল-বাকারাহ ২: ১৮২)
তাক্ওয়া অর্জন রোযার মূল উদ্দেশ্য। রোযার মাধ্যমে মানুষ তাক্ওয়া,
পরেহযগারীর গুণ অর্জন করে। নফ্সের বৈধ চাহিদা পরিহার করে, কুপ্রবৃত্তিকে
ত্যাগ করে, ধৈর্যের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভে এগিয়ে যায়। এ
বিষয়ে যদি আমরা আরও গভীরভাবে চিন্তা করি তাহলে দেখা যাবে, রোযা এমন একটি
ইবাদত যার পূর্ণ পালন রোযাদারের সততার ওপর নির্ভর করে। এখানে আল্লাহ ছাড়া
তার খবরদারী করার কেউ নেই। সে যখন আল্লাহ্র প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দিনের
বেলায় তার সকল সাধের খাদ্য দ্রব্য ত্যাগ করে এবং একটি মাস ব্যাপী এ অনুশীলন
করে তখন তার মধ্যে সৃষ্টি হয় পূর্ণ ঈমান।
মাহে রমযান সমগ্র পরিবেশকে নেকী আর পরহেযগারীর পবিত্র ভাবধারায় উজ্জ্বল করে
তুলে। প্রত্যেক ব্যক্তি কেবল নিজের গুনাহ্ হতে বাঁচাতে চেষ্টা করে না বরং
তার মধ্যে কোন প্রকার দুর্বলতা থাকলে তার জন্য অন্য সব রোযাদার ভাই তার
সাহায্য ও সহযোগিতা করে। রোযা রেখে গুনাহ করতে প্রত্যেকটি মানুষের লজ্জাবোধ
হয়; পক্ষান্তরে প্রত্যেকের মনে কিছু ভাল ও সাওয়াবের কাজ করার ইচ্ছা জাগে।
কোথাও নেক কাজ হতে দেখলে তাতে অংশগ্রহণ করে। আর কোথাও প্রকাশ্যভাবে পাপ
অনুষ্ঠান হতে থাকলে তা বন্ধ করতে চেষ্টা করে। এভাবে চারদিকে নেকী ও
তাক্ওয়ার একটি মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়। গোটা সমাজে এবং সারা বিশ্বে এমন
একটি স্বর্গীয় পরিবেশ আমাদের আচ্ছন্ন করে নেয় মাহে রমযান। হাত ছানি দিয়ে
ডাকতে থাকে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের পথে। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) হাদীসে
কুদসীতে বলেছেন, ‘বণী আদমের সকল আমলের বিনিময় দশগুণ হতে সাতশত গুণ পর্যন্ত
বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু আল্লাহ্ বলেন, রোযা এর ব্যতিক্রম। কেননা, রোযা আমার
জন্য। আর এর বিনিময় আমিই দান করব’ (সহীহ বুখারী, হাদীছ নং ১৭৭১; সহীহ
মুসলিম, বাবু ফাযলিস্-সিয়াম, হাদীছ নং ১৯৪৫; সুনানু ইব্ন মাজাহ্, হাদীছ
১৬২৮)। রমযানের এ তাক্ওয়া প্রশিক্ষণই পরবর্তী এগারটি মাসে তাকে বাধা দেবে
সকল প্রকার অশ্লীল কাজ থেকে। বাধা দেবে তাকে সুদ, ঘুষ, কালো বাজারী,
রাহাজানী, ছিনতাই, মাদকাশক্তি, ব্যভিচার এবং সকল প্রকার সামাজিক অন্যায়
আচরণ থেকে। অতএব বলা যায়, মাহে রমযানই হলো তাক্ওয়া শিক্ষার উত্তম সময়।
মাহে রমযান ধৈর্য ও সংযম শিক্ষা দেয়
বছরের সব কয়টি মাসের মধ্যে রমযান শ্রেষ্ঠ মাস। মানুষের গুণাবলীর মধ্যেও
শ্রেষ্ঠ ও উত্তম গুণ হলো ধৈর্য এবং সংযম। ধৈর্যকে কোরআনের ভাষায় বলা হয়
সবর। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও স্তরে ধৈর্যের প্রয়োজন। কঠিন কাজের
সময় প্রয়োজন হয় ধৈর্যের। ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় ধৈর্য ও সবরের।
আল্লাহ্ তাআলা বলেন, ‘বিপদ-আপদ, অর্থ সংকট এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে যারা ধৈর্য
ধারণ করে তারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকী। নেক আমল এবং ইবাদতের সময়
সবরের প্রয়োজন অধিক হওয়ায় আল্লাহ্ তাআলা নেক আমলের পূর্বেই সবরের উল্লেখ
করেছেন। (সূরা আল-বাকারা: ২ : ১৭৭)। অপর আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেন,
‘যারা ধৈর্যশীল ও সৎকর্মপরায়ণ তাদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার’
(সূরা হূদ : ১১)।
রোযা মানুষকে ধৈর্য ও সহনশীলতা শিক্ষা দেয়। মুমিন বান্দাগণ রমযানের পূর্ণ
মাসে লাভ করেন ধৈর্যের এক অপূর্ব প্রশিক্ষণ। ধৈর্য ছাড়া রমযানের রোযা পালন
করা সম্ভব নয়। রোযা রাখতে গিয়ে প্রবৃত্তি ও শয়তানের সাথে প্রতিনিয়ত
মোকাবেলা করতে হয় ধৈর্য ও সবরের মাধ্যমে। রোযা এমন একটি ইবাদত যা অন্যের
চক্ষু গোচর হয় না। ফলে রোযাদার যদি দিবাভাগে লুকিয়ে লুকিয়ে পানাহার করে তবে
কেউ তা বুঝতে পারবে না। কিন্তু রোযাদার সুবহে সাদেকের পর থেকে সূর্যাস্ত
পর্যন্ত ক্ষুৎ-পিপাসার কষ্ট সহ্য করে অকাতরে, স্বতঃস্ফুর্তভাবে, আন্তরিকতা
সহকারে এবং আল্লাহ্র নিকট থেকে বিনিময় লাভের উদ্দেশ্য নিয়ে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন